বাংলাদেশঃ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক- মহাসড়কই সবচেয়ে নিম্নমানের।
বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট-২০১৫ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সড়ক- মহাসড়কই সবচেয়ে নিম্নমানের। এশিয়ার সড়ক অবকাঠামো সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ২ দশমিক ৯, যা এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। অপরিকল্পিত সড়ক-মহাসড়কই দুর্ঘটনাসহ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করছে। বুয়েটের অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূর বলেন, সর্বশেষ ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন করার সময়েও ধীরগতির যানবাহনের জন্য সাবওয়ে রাখার কথা ভাবা হয়নি। এটাই প্রমাণ করে_ সড়ক-মহাসড়ক অবকাঠামো নির্মাণে পরিকল্পনা সঠিকভাবে হচ্ছে না।
বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ মহাসড়কগুলোর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন মহাসড়ক। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চেয়ে কম গাড়ি চলাচল করলেও এই মহাসড়কে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ মহাসড়কের চেয়ে ১০ গুণ বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদন-২০১৫ থেকে জানা গেছে, সড়ক অবকাঠামোর মানের দিক থেকে এশিয়ার সব দেশগুলোর নিচে বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে ১০৯তম স্থানে। সড়ক অবকাঠামো সূচকে ১০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২ দশমিক ৯, ভারতের ৩ দশমিক ৮, চীনের ৪ দশমিক ৬, কম্বোডিয়ার ৩ দশমিক ৪, পাকিস্তানের ৩ দশমিক ৮। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কার স্কোর ৫ দশমিক ১ ও থাইল্যান্ডের ৪ দশমিক ৫।
দক্ষিণ এশিয়া উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বা সাসেক রোড করিডরের তিনটি রুট গেছে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। রুট তিনটির দৈর্ঘ্য এক হাজার ৪৮১ কিলোমিটার। সওজের সমীক্ষা অনুযায়ী, এর মধ্যে এক হাজার ৩১৮ কিলোমিটার বা ৮৯ শতাংশই নিম্নমানের।
গত বছর প্রকাশিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবির কারিগরি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সওজ অধিদপ্তরের মহাসড়কের ৭৩ শতাংশই মানহীন। আন্তর্জাতিক সড়ক সমীক্ষা কর্মসূচির আওতায় প্রত্যক্ষ জরিপে উঠে এসেছে এই চিত্র। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোকে মানের ক্রমানুসারে পাঁচ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহাসড়কের ৪৫ শতাংশ পঞ্চম ক্যাটাগরির। এসব মহাসড়ক কালো তালিকাভুক্ত। কোনো হিসাবেই এগুলো মহাসড়কের মধ্যে পড়ে না। চতুর্থ ক্যাটাগরিতে আছে ২৮ শতাংশ। এগুলো লাল তালিকাভুক্ত। মানদণ্ডের খুব কম বৈশিষ্ট্য আছে এগুলোয়। এই ৭৩ শতাংশ সড়ক-মহাসড়কই মানহীন। বাকি ২৬ শতাংশ মাঝারি মানের উল্লেখ করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কমলা তালিকায়। মোটামুটি আদর্শ মানের মহাসড়ক মাত্র ১ শতাংশ উল্লেখ করে হলুদ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আদর্শ মহাসড়ক পাঁচ তারকা বা সবুজ তালিকাভুক্ত। এ হিসাবে দেশে আন্তর্জাতিক মানের আদর্শ সড়ক-মহাসড়ক নেই। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৮৭ শতাংশই নিম্নমানের। এর মধ্যে ৭২ শতাংশ কালো তালিকাভুক্ত। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৪৪ শতাংশ, জয়দেবপুর-জামালপুর মহাসড়কের ৬০ শতাংশ, জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল- এলেঙ্গার ৫৭ শতাংশ, ঢাকা-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের ৭৬ শতাংশ, কাশিনাথপুর- রাজশাহী মহাসড়কের ৮১ শতাংশ, দৌলতদিয়া-মংলা মহাসড়কের ৭৫ শতাংশ ও ঢাকা-পটুয়াখালী মহাসড়কের ৮২ শতাংশ নিম্নমানের।
দেশের ৯৬ শতাংশ মহাসড়ক দুই লেনের। এগুলোয় সড়ক বিভাজক নেই। তবে ৭৭ শতাংশ মহাসড়কে বিভাজক চিহ্ন আছে। আর ১ শতাংশ মহাসড়কের দুই পাশে নিরাপত্তামূলক বেষ্টনী রয়েছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন- ইউএন- এসকাপ এশীয় মহাসড়কভুক্ত ৩২টি দেশের বর্তমান সড়কচিত্র বিষয়ে গত ১৯ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে এশীয় মহাসড়কের জন্য চিহ্নিত এক হাজার ৭৬০ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ৩১১ কিলোমিটার প্রথম শ্রেণির। ৭২ কিলোমিটার চার লেন। ৮৯ শতাংশ বা এক হাজার ৫৫৩ কিলোমিটার দুই লেনের ও দ্বিতীয় শ্রেণির। বাকি ১১৬ কিলোমিটার তৃতীয় শ্রেণির বা তারও নিচের। এসব সড়কে ১৫ টন ওজনের বেশি পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করতে পারবে না। জয়দেবপুর থেকেনঢাকা হয়ে কাঁচপুর পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার প্রথম শ্রেণির সড়ক আছে। তবে পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত অংশটি তৃতীয় শ্রেণি বা তারও নিচে। বাকি অংশ দ্বিতীয় শ্রেণির।
এশীয় মহাসড়কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শক্ত সড়ক কাঠামো আছে চীন, জাপান, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক ও মালয়েশিয়ায়। ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড মহাসড়ক উন্নয়নে আগে থেকেই প্রকল্প নিচ্ছে। ভারতে ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে তা হয়নি। জানা গেছে, এশীয় মহাসড়কে অযান্ত্রিক ও ধীরগতির যানবাহন চলাচল করে না। এগুলো চলাচলের জন্য মূল মহাসড়কের পাশে সার্ভিস লেন থাকে। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে একমাত্র বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে। এশীয় মহাসড়কে থাকে নিরাপত্তামূলক সীমানাপ্রাচীর। গাড়ির গতি থাকে ১২০ কিলোমিটার। প্রতিটি মহাসড়ককে হতে হয় কমপক্ষে চার লেনের। এগুলোয় কোনো মোড় থাকে না। বাংলাদেশে এ ধরনের মহাসড়ক খুব কম।
দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সরকার গত ২২ জুলাই থেকে মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। এ ছাড়া অন্যান্য নিষিদ্ধ গাড়ি চলাচলও করতে পারবে না। অথচ ধীরগতির যানবাহন চলাচলের জন্য মহাসড়কে আলাদা লেন বা বিকল্প সড়ক থাকলে তা নিষিদ্ধ করতে হতো না। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছাড়াও বিভিন্ন মহাসড়কে বিজ্ঞানসম্মত নকশা, নির্মাণশৈলী, নির্মাণ উপকরণে পরিবর্তন এনে আদর্শ মহাসড়ক তৈরি করানহচ্ছে। আমাদের দেশে বর্ষায় জলাবদ্ধতার কারণে পিচ নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে মহাসড়কের বাজার এলাকাগুলো কয়েক বছর ধরে কংক্রিটের মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে।
তথ্য সূত্রঃ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক।
0 comments:
Thank you